কোরবানি! শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে ঈদের দিনের সেই বিশেষ মুহূর্ত—নতুন জামা, মাংসের রান্নার সুগন্ধ, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আল্লাহর রাহে একটি পশু উৎসর্গ করার তৃপ্তি। কিন্তু অনেকেই জানি না, এই কোরবানির পেছনে কত গভীর একটা শিক্ষা লুকিয়ে আছে। এটা শুধু পশু জবাই করার একটা নিয়মিত উৎসব নয়, বরং এটা আমাদের বিশ্বাস, আত্মত্যাগ আর আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এক বিশাল সুযোগ।
প্রতিবার ঈদুল আজহা এলে আমরা পশু কিনি, যত্ন করি, আর ঠিক সময়ে তা কোরবানি করি। কিন্তু অনেকেই সঠিক নিয়ম, দোয়া আর পদ্ধতি সম্পর্কে ঠিকমতো জানি না। অনেক সময় আমরা ভুল করি শুধু জানার অভাবে, আর তাতে আমাদের ইবাদতে ঘাটতি থেকে যায়। আপনি যদি সত্যিই আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে চান, তবে দরকার কোরবানির আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা—যেমন: কোন দোয়াটা পড়তে হবে, কীভাবে পশুকে জবাই করতে হয়, কোন কোন শর্ত মানতে হয়, ইত্যাদি।
![]() |
কোরবানির পশু জবাই করার সঠিক দোয়া, নিয়ম ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ২০২৫ |
কোরবানির তাৎপর্য ও ফজিলত
কোরবানি মানে শুধু একটা পশু জবাই করা না—এটা আমাদের ভেতরের ত্যাগের প্রতীক। কোরবানির মাধ্যমে আমরা শিখি কীভাবে নিজের ভালোবাসার জিনিস আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে হয়। এটা একটা বড় আত্মিক চর্চা, যেখানে আমরা আল্লাহর প্রতি নিজের ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আনুগত্য প্রকাশ করি।
এই ইবাদতের মাধ্যমে গরীব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়ার আনন্দ হয়। ফলে কোরবানি আমাদের মধ্যে সহানুভূতি, ঐক্য আর মানবিকতা জাগায়।
আল্লাহ কোরবানির রক্ত বা গোশতের দিকে তাকান না, বরং তিনি দেখেন আমাদের নিয়ত, আমাদের ভেতরের তাকওয়া বা ভয়। কোরবানি সেই তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ—যেখানে আমরা বলি, “হে আল্লাহ, তোমার সন্তুষ্টির জন্যই আমি এই কোরবানি করছি।”
ইসলামে কোরবানির ইতিহাস
কোরবানির ইতিহাস বহু পুরোনো। এটা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং শুরু থেকেই আল্লাহর নবী-রাসূলদের যুগে এই ইবাদত ছিল। কিন্তু ইসলাম ধর্মে কোরবানিকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা অনন্য।
মহানবী মুহাম্মদ (সা.) কোরবানিকে ঈমানের অন্যতম অংশ হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে।” এই হাদিস থেকেই বোঝা যায়, কোরবানির গুরুত্ব কতটা বেশি।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানির ঘটনা
এটা এমন এক ঘটনা, যেটা শুনলে মন কেঁপে ওঠে। আল্লাহর এক প্রিয় বন্ধু ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। অনেক বছর দোয়া করে তিনি এক ছেলে (হজরত ইসমাইল আ.) পেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এক কঠিন পরীক্ষা দিলেন—তাঁকে আদেশ দিলেন যেন নিজের ছেলেকে কোরবানি করেন!
ভাবুন তো, নিজের সন্তান, যাকে তিনি বহু কষ্টে পেয়েছেন—তাকে নিজ হাতে কোরবানি করা! কিন্তু ইব্রাহিম (আ.) বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে আল্লাহর হুকুম মানতে প্রস্তুত হলেন। তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.)-ও বললেন, “আব্বা, আপনি যা আদেশ পেয়েছেন, তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আমি ধৈর্য ধরব।”
এই ত্যাগ দেখে আল্লাহ এত খুশি হলেন যে, তিনি ইসমাইল (আ.)-কে বাঁচিয়ে দিলেন এবং তাঁর জায়গায় একটি দুম্বা পাঠালেন। আর এই ঘটনার স্মরণেই আজ আমরা পশু কোরবানি করি—তাঁদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
এই ইতিহাস আমাদের শেখায়—আল্লাহর পথে কিছু ত্যাগ করতে হলে কষ্ট হবে, কিন্তু তার প্রতিদান অনেক বড়। কোরবানি মানে শুধু ছুরি চালানো নয়, কোরবানি মানে নিজের লোভ, অহংকার, স্বার্থপরতা কেটে ফেলা। আল্লাহর জন্য নিজের প্রিয় জিনিস ছেড়ে দিতে পারলেই, সেটাই সত্যিকারের কোরবানি।
কোরবানি কারা করতে পারবে?
সবাই কি কোরবানি দিতে পারে? আসলে কিন্তু না। কোরবানির জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত আছে, যেগুলো পূরণ না হলে কোরবানি ওয়াজিব হয় না।
কোরবানির জন্য শর্তসমূহ
একজন মুসলমানের উপর কোরবানি তখনই ওয়াজিব হয়, যখন নিচের এই কয়েকটি শর্ত পূরণ হয়—
- বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে: ছোট বাচ্চাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়।
- আক্ল বা সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে: মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তির উপর কোরবানি ফরজ নয়।
- মুসলমান হতে হবে: অমুসলিমদের উপর কোরবানির বিধান প্রযোজ্য নয়।
- নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে: যার কাছে কোরবানির দিন সকালবেলা (ঈদের নামাজের পর) প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকে—যেমন টাকা-পয়সা, স্বর্ণ, রূপা, ব্যবসার মাল ইত্যাদি—তার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
👉 সহজ করে বললে, যার নিজের খরচ চালিয়ে অতিরিক্ত টাকা বা সম্পদ থাকে, সে কোরবানি দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ।
কোরবানির উপযুক্ত পশু
সব পশুই কি কোরবানির জন্য উপযুক্ত? না, কিছু নির্দিষ্ট ধরন ও মানের পশু কোরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য।
গরু, খাসি, ছাগল, উট — কোনটি কোরবানির জন্য উত্তম?
ইসলামী শরিয়ত অনুসারে কোরবানির জন্য উপযুক্ত পশুর মধ্যে রয়েছে—
- গরু বা মহিষ – এতে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারেন। তবে শর্ত হলো, সবাইকে সমান হকদার হতে হবে।
- খাসি বা ছাগল – এক ব্যক্তি একাই কোরবানি দিতে পারবেন।
- উট – এটিও সাতজন পর্যন্ত শরিক হয়ে কোরবানি করা যায়।
👉 কোনটি উত্তম? এটি নির্ভর করে আপনার সামর্থ্য ও প্রয়োজনের উপর। বড় পশুতে যেমন শরিক হওয়া যায়, ছোট পশু একার জন্য উপযুক্ত।
পশুর বয়স ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিধান
কোরবানির পশু শুধু দেখতে ভালো হলেই হবে না, তার বয়স ও স্বাস্থ্যের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। শরিয়ত অনুযায়ী—
- গরু ও মহিষ: বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে।
- ছাগল, খাসি ও ভেড়া: বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। তবে যদি ৬ মাসের ভেড়া এমন হয় যে, দেখতে এক বছরের মতো লাগে, তাহলে সেটাও কোরবানির জন্য চলবে।
- উট: বয়স কমপক্ষে ৫ বছর হতে হবে।
আর স্বাস্থ্য কেমন হবে?
- দুই চোখ ঠিকঠাক দেখতে পায় এমন হতে হবে।
- একদম রোগা বা দুর্বল হওয়া চলবে না।
- খোঁড়া বা পঙ্গু হলে চলবে না।
- কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটা বা ভাঙা থাকলে কোরবানির যোগ্য নয়।
👉 সহজভাবে বললে, পশুটা যেন সুন্দর, সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ হয় — এমনটাই চায় ইসলাম।
কোরবানির সময় ও স্থান
কখন এবং কোথায় কোরবানি করা যাবে, সেটা নিয়েও ইসলামে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা আছে।
কোরবানির নির্ধারিত দিন
কোরবানির নির্ধারিত সময় মোট তিন দিন—
- ১০ জিলহজ (ঈদের প্রথম দিন)
- ১১ জিলহজ
- ১২ জিলহজ
সবচেয়ে উত্তম হলো ঈদের নামাজ পড়ে প্রথম দিনেই কোরবানি করা। কারণ, রাসূল (সা.) নিজেও প্রথম দিনে কোরবানি করতেন।
👉 ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা যাবে না। করলে সেটা কোরবানি হিসেবে গৃহীত হবে না, বরং সাধারণ জবাই হিসেবে গণ্য হবে।
কোথায় কোরবানি করা উচিত
কোরবানির স্থান নির্বাচন করতেও কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি—
- এমন জায়গা বেছে নিতে হবে, যেখানে পরিবেশ দূষণ না হয়।
- জনসমক্ষে জবাই না করাই উত্তম, যাতে কেউ আহত না হয় বা ছোটদের মনে খারাপ প্রভাব না পড়ে।
- বাড়ির উঠোন, খোলা জায়গা, কসাইখানা বা নির্ধারিত কোরবানির মাঠ — যেখানেই করেন না কেন, পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
👉 কোরবানি যেন শুধু একটা রীতি না হয়ে, মানবতা ও সচেতনতার প্রতীক হয় — সেদিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
কোরবানির আগের প্রস্তুতি
পশুর যত্ন ও পরিচর্যা
কোরবানির পশু শুধু একটা কেনা প্রাণী না, এটা আমাদের আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার জন্য নেওয়া আমানত। তাই এর যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। পশুটিকে যেন ভালো খেতে দেয়, পরিষ্কার পানি দেয়, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে এবং কখনোই মারধর বা খারাপ ব্যবহার না করে। পশু যতটা সুস্থ থাকবে, ততটাই সুন্দরভাবে কোরবানি আদায় করা যাবে। এমনকি অনেক আলেম বলেন, কোরবানির আগে পশুর সাথে সুন্দর ব্যবহার করাও সওয়াবের কাজ।
দোয়া ও নিয়ত করার প্রস্তুতি
কোরবানি দেওয়ার আগে নিজের মনটা পরিষ্কার করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিয়ত করা জরুরি। নিয়ত মানে হচ্ছে — আপনি এই কাজটা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছেন। এটি মুখে বলাও যেতে পারে, আর মনের ভিতর করলেই যথেষ্ট। এছাড়া, জবাই করার সময় যে দোয়াটি পড়তে হয় সেটি আগে থেকেই মুখস্থ করে রাখা ভালো। যারা নিজে জবাই করবেন না, তারাও অন্তত মনে মনে এই নিয়তটা ঠিকভাবে করে নিতে পারেন।
কোরবানির জবাই করার সঠিক পদ্ধতি
ইসলামী শরিয়ানুযায়ী সঠিক নিয়ম
কোরবানির নিয়মটা আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন যেন পশুটাকে কষ্ট না দিয়ে সুন্দরভাবে জবাই করা হয়। নিচে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করছি:
- পশুটিকে ধৈর্যের সাথে ধরে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে।
- জবাই করার ছুরি অবশ্যই ধারালো হতে হবে। ভোঁতা ছুরি দিয়ে কাটা একদমই ঠিক নয়।
- জবাই শুরু করার আগে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলা ফরজ।
- গলা কেটে তিনটি প্রধান শিরা কেটে দেওয়া — শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও রক্তনালী — যেন দ্রুত মৃত্যু হয় ও কষ্ট কম হয়।
- জবাইয়ের সময় অন্য কোনো পশুর সামনে যেন এটা না করা হয়, এতে পশুগুলো ভয় পায় — এটা ইসলামে নিরুৎসাহিত।
জবাইকারীর জন্য প্রয়োজনীয় আদব ও শর্ত
যিনি কোরবানি করবেন তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি থাকা দরকার:
- তিনি অবশ্যই মুসলমান হতে হবে।
- তার মধ্যে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি থাকতে হবে।
- যেন পশুর প্রতি দয়া থাকে এবং যথাসম্ভব কষ্ট না দিয়ে জবাই করেন।
- জবাই করার সময় যেন দ্রুততা ও সতর্কতা থাকে, যেন পশু ব্যথা না পায়।
- আর হ্যাঁ, জবাইয়ের পর হাসাহাসি বা খেলা করা একদমই ঠিক নয় — এটা একটি ইবাদত, সেটা মাথায় রাখা উচিত।
কোরবানির সময় পড়ার দোয়া
দোয়া আরবি ও বাংলা উচ্চারণ
জবাই করার সময় পড়ার দোয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে দোয়াটি আরবি, উচ্চারণ ও অর্থসহ দেওয়া হলো:কোরবানির পশু কেবলামুখী করে শোয়ানোর পর এই দোয়াটি পাঠ করবে- ছাগল জবাই করার দোয়া, কোরবানির শরিকের নিয়ম :
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ، اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ
‘ইন্নি ওয়াজ জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাবিবল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়ালাকা।’ আবু দাউদ: ২৭৯৫)
জবাইয়ের পরে করণীয়
গোশত বণ্টনের নিয়ম
কোরবানির পর শুধু জবাই করলেই শেষ না, বরং গোশত সঠিকভাবে ভাগ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে:
- ১/৩ (এক-তৃতীয়াংশ) গরীব ও অসহায় মানুষদের দিতে হবে।
- ১/৩ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের দিতে পারেন।
- ১/৩ নিজের পরিবার ও আত্মীয়দের জন্য রাখতে পারেন।
গরীবদের অংশ গোপনে দিলে আল্লাহ বেশি খুশি হন। আবার যদি কেউ চায় পুরোটা গরীবদের দান করতেও পারেন, এটা আরও ভালো।
পশুর চামড়া ও অন্যান্য অংশ ব্যবস্থাপনা
অনেকে কোরবানির চামড়া বিক্রি করে নিজের জন্য ব্যবহার করেন — এটা ঠিক নয়। চামড়া বিক্রি করে যা পাওয়া যায়, সেটা গরীবদের দান করা উত্তম। এছাড়া মাথা, পা বা ভুঁড়ি— এগুলো পরিষ্কার করে নিজে খাওয়া যেতে পারে বা দান করাও যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় — কোরবানির জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে ভুলবেন না। পরিবেশ ঠিক রাখা, প্রতিবেশীদের কষ্ট না হওয়া, এটাও আমাদের দ্বীন ইসলামের শিক্ষা।
নারীদের কোরবানিতে ভূমিকা
অনেকেই ভাবেন, কোরবানি হয়তো শুধুই পুরুষদের কাজ। কিন্তু আসলে তা নয়। ইসলামে নারীদের কোরবানি দেওয়া একদমই বৈধ। নারীরা চাইলে নিজের নামে কোরবানি দিতে পারেন এবং এতে পুরুষদের অনুমতির প্রয়োজন নেই যদি তারা নিজ উপার্জনে তা করেন।
তবে বাস্তবে জবাই করা শারীরিকভাবে কঠিন বলে নারীরা সাধারণত জবাইয়ের কাজটা করে থাকেন না, কিন্তু তারা কোরবানির গোশত বণ্টন, রান্না, পশুর পরিচর্যা—এসব কাজে বিশাল ভূমিকা রাখেন। কোরবানির প্রস্তুতি থেকে শুরু করে বণ্টন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নারীদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
কোরবানির সময় যেসব ভুল এড়ানো উচিত
কোরবানি করতে গিয়ে আমরা অনেকেই কিছু সাধারণ ভুল করে ফেলি, যেগুলো না জানার কারণে হয়। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুলের কথা বলছি, যেগুলো অবশ্যই এড়ানো উচিত:
- অযোগ্য পশু কোরবানি করা: যেমন খুব দুর্বল, একচোখা, ল্যাংড়া, অসুস্থ বা জন্ম থেকে কানে বা শিংয়ে সমস্যা থাকা পশু কোরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।
- জবাইয়ের সময় দোয়া না পড়া: “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” না বলে জবাই করলে কোরবানি সহীহ হয় না।
- অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দেওয়া: পশুকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া, বেঁধে রাখা, ধাক্কা দেওয়া — এসব করা নিষেধ। আল্লাহর সৃষ্টি, তাই দয়া ও সহানুভূতি থাকা উচিত।
- গোশতের অন্যায় বণ্টন: নিজের জন্য বেশি রেখে দরিদ্রদের কম দেওয়া, আত্মীয়দের বাদ দেওয়া এসব কোরবানির মূল উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে যায়।
- চামড়া বিক্রি করে টাকা ব্যবহার করা: এটা একেবারেই নিষেধ। চামড়া দান করে দিলে সবচেয়ে ভালো হয়।
পরিবেশবান্ধব ও মানবিক কোরবানি নিশ্চিত করা
আমরা সবাই জানি, কোরবানির সময় পরিবেশ অনেক নোংরা হয়ে যায়। কিন্তু একটু সচেতন হলেই আমরা পরিবেশবান্ধব কোরবানি করতে পারি। যেমন:
- পরিষ্কার জায়গায় কোরবানি করা: যেখানে ড্রেনেজ ভালো, সহজে রক্ত ও বর্জ্য পরিষ্কার করা যায়।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: পশুর না-ব্যবহারযোগ্য অংশ যেমন অন্ত্র, পা, নখ—এসব যত্রতত্র না ফেলে, ঢেকে রাখা বা পৌরসভার নির্ধারিত স্থানে ফেলা উচিত।
- মানবিক আচরণ: পশুর চোখে কাপড় বেঁধে কোরবানি করা, দ্রুত জবাই করা যেন কষ্ট না পায়—এসব ছোট কাজেও মানবিকতা প্রকাশ পায়।
আসুন, আমরা কোরবানিকে শুধু ইবাদত নয়, পরিচ্ছন্নতা, মানবতা ও সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেও দেখি।
উপসংহার
কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই নয়—এটা আত্মত্যাগের প্রতীক। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মরণে আমরা যে পশু কোরবানি দেই, তা যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, নিয়ম মেনে, মানবিকতা ও পরিবেশের দিকে খেয়াল রেখে। নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব সবাই মিলে যদি আমরা সত্যিকারের কোরবানি করতে পারি, তাহলে তবেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১. নারীরা কি নিজের নামে কোরবানি দিতে পারে?
হ্যাঁ, একজন নারী চাইলে নিজের উপার্জন দিয়ে নিজের নামে কোরবানি দিতে পারেন। ইসলামে এতে কোনো বাধা নেই।
২. অসুস্থ পশু কোরবানি করলে কি হবে?
যদি পশুটি কোরবানির জন্য অযোগ্য হয় (যেমন: খুব দুর্বল, চোখ অন্ধ, পঙ্গু), তাহলে সেই কোরবানি গ্রহণযোগ্য হবে না।
৩. কোরবানির গোশত সম্পূর্ণ নিজের পরিবারে রাখা যাবে কি?
শরিয়তে বলা হয়েছে, তিন ভাগ করা উত্তম—নিজে রাখা, আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া এবং গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা।
৪. কোরবানির দোয়া না পড়ে জবাই করা হলে কি হবে?
দোয়া না পড়া গুরুতর ভুল। ইচ্ছাকৃতভাবে না পড়লে কোরবানি সহীহ হবে না। ভুলবশত হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত।
৫. কোরবানির পরে পশুর চামড়া কীভাবে ব্যবহার করা উচিত?
সবচেয়ে ভালো হলো চামড়া দান করে দেওয়া। বিক্রি করে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।